গণজাগরনে জেগে উঠা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের মধ্যি দিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়েছেন । জাতিয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে । সেনাপ্রধানের সমন্বয়ে আর রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যি দিয়েই হচ্ছে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকারের রুপরখোর পরিকল্পনা । নিশ্চিত করা হয়েছে এ সরকারের অবয়ব। সেজন্য বাংলাদেশ কার্যত সরকারবিহীন এক দেশ ২৪ ঘন্টারও বেশী সময়, অর্থাৎ এ সরকারের পুরো টিমের শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত ।
কিন্তু সরকার থাকা অবস্থায় অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের মাত্র শেষ কটা দিনে যা ঘঠে গেলো তা দুঃখজনক, প্রত্যেকটি ঘঠনাই জন্ম দিয়েছে লোমজাগানো ভংকরতার চিত্র । শিশু গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে, এক-দুজন নয় পঞ্চাশের কাছাকাছি। গত ১ জুলাই থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ নিহত হয়েছেন ৪ শতাধিক । শাষকদের হাতে গনজাগরনের ছাত্র-জনতাকে গুলি করা হয়েছে পাখির মত, কিন্তু গণজোয়ারের পর্যদুস্থ সরকারের ঘাতক বাহিনীও একসময় প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনে নি । অমানবিকতাটা এমন পর্যায়ে পৌচেছিলো যে, উত্তাল গনজোয়ারে পাল্টা আক্রমনে ঘাতকরাও মরতে থাকে, থানা লুট হতে থাকে. ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের মানুষের নিহত হবার খবর বিচলিত করতে থাকে ঘাতকদের এবং সরকারকেও । পুলিশদের পিছু হটতে থাকে এমনকি নিজস্ব পোশাক বদল করে জনতার সাথে মিশে যেতে থাকে । এমপি-মন্ত্রী’ নেতাদের বাড়ি আগুনে প্রজ্জলিত হতে থাকে । কে নেভাবে এ আগুন ? কেউ না । দুঃখজনক বাস্তবতা হল, দেশের বিভিন্ন জেলায়-উপজেলায় অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর মূর্তিগুলো অপমানজনকভাবে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে । বিগত চৌদ্দ বছরের নয়, শেষ ১০ বছরের ক্ষোভ দেখি আমরা এই লেলিহান শিখায় । দেখামাত্র মন্ত্রির গুলির আদেশ আর কল্কে পায় নি। মন্ত্রীরাই পালাতে থাকে, পালায়। কেউবা ধরা পড়েছে বিমানবন্দরেই ।
গণভবন আর সংসদ ভবন যখন আক্রান্ত হয়, মানুষের উল্লাস রুপ নেয় বেলেল্লাপেনার নৃত্যে । লুট হতে থাকে । এ লুটে নে লজ্জা আছে, কষ্ট আছে—–শাড়ি পরে অন্তর্বাসসহ এমন কিছু ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছাপিয়ে দিয়েছে লুটপাটকারীরা, যা যে কোন মানষিক মানুষকে লজ্জা দেয় এবং মনে করিয়ে দেয় গনঅভ্যূত্থানেও দুর্বৃত্ত থাকে । এরকম দুর্বৃত্তদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন ।
বিপ্লব এরকমই হয়ত । ভেঙ্গে পড়ে অনেক কিছু, তৈরী হয় অনেক ধ্বংসস্তুপের । ৭১ এ আমরা স্বাধিন হয়েছি । লক্ষ লক্ষ শহিদের রক্ত ছাড়াও জাতির প্রয়োজনে ধ্বংস হয়েছিলো তখন অনেক কিছু। মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজ ভেঙ্গেছিলো, অনেক স্থাপনাই জ্বালিয়ে দিয়েছিলো তারাই, অন্যদিকে তা করেছিলো রাজাকার পাকবাহিনীও, তবুও সে এক গৌরবের অধ্যায় বাঙ্গালি জাতির। ধ্বংসস্তূপ থেকে একাত্তরেই শুরু হয়েছিলো দেশ গড়া । কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সময়ে সময়েই আক্রান্ত হয়েছে । রাজনৈতিক ভূলের কারনে হোক আর উচ্চাভিলাষী সেনা সদস্যরে কারনেই হোক, ৭৫এ যেমন বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ড ঘঠেছে, ঠিক তেমনি সময়ে সময়ে দেশে ছায়া ফেলেছে কালো মেঘ । স্বৈরাচারীরা এসেছে, গণতন্ত্র ভূলন্ঠিত করেছে এরা । অবকাঠামগত উন্নয়ন হয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদ আমলেও, হয়েছে কিছুটা হলেও জামাত-শিবির সরকারের সময়ে । কিন্তু তারা দেশটাকে উগ্র সাম্পদ্রায়িক রাষ্ট্র হিসেবেই পৃথিবীর কাছে আমাদের পরিচিত করেছিলো, একে একে স্বাধীনতার চেতনা তখন ভূলুন্ঠিত হচ্ছিল । আর এ আমলে এসে চেতনা বিক্রি হতে থাকলো দাড়ি-পাল্লায় অর্থাৎ ওজনের মধ্যি দিয়ে । উন্নয়ন একটা প্রক্রিয়া আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যি দিয়ে শত-সহস্র কোটি টাকার সম্পত্তিওয়ালা আমলা-রাজনীতিক-দালাল-ফড়িয়া-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী এমনকি সাধারন চাকুরিজীবীদের চেতনাবাজ একটা শ্রেনীর উত্থান হল। পাশাপাশি দেশপ্রেমহীন ঐ সুবিধাভোগী শ্রেনী লাখ লাখ কোটি টাকা শুধু পাচারই করতে থাকল ইংল্যান্ড ইউরোপ-কানাডা আমেরীকায়, গুম-ঘুষ দুর্বৃত্তায়নের ছেয়ে গেলো গোটা দেশ, মোদ্দা কথায় একনায়ক আর স্বৈরতন্ত্রের এক অভয়ারন্য হয়ে গেলো বাংলাদেশ ।
স্বাভাবিকভাবেই দেশের একটা ঝাকুনী প্রয়োজন ছিল । ইতিহাস কখন যে কোনদিকে বাঁক নেয়, স্বৈরশাসক কিংবা তার দোসররা যদি জানত, তাহলে আজকের বাংলাদেশ তারা হতে দিতো না । একটা চরম অনিশ্চয়তার মাঝে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করা হয়েছে । তাঁর নেতৃত্বেই আসবে নতুন একটা টীম । স্বাভাবিকভাবেই এই দলে থাকবে না একটানা প্রায় ১৫ বছরের শাষন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা সমাজচিন্তাবীদ। তাই দেখা যাবে, সারা দেশের মানুষের আশা আকাংখার প্রতিফলনও হয়ত হবে না হচ্ছে না এই এই সরকারের সকল সদস্যদের নিয়ে, সংশয় থাকতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলার এ মুহূর্তে কি কেউ থাকবে ? জনশ্রুতি আছে, বিগত সরকারের আমলে পাশ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ থেকে । যদিও ভারতের বিদেশ মন্ত্রীর আজকের(৬ আগষ্ট) তাদের সংসদে ভাষনটা খুবই গুরুত্বপূর্ন, যে ভাষনে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বে সমালোচনা করেন নি, বরং বাংলাদেশের মানুষের কিছুটা প্রশংসা করেই বলেছেন সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু জনগুষ্টিকে দেশের সাধারন মানুষ কিংবা আন্দোলনকারীরা সুরক্ষা দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে । অর্থাৎ পার্শ্ববর্তি দেশ হিসেবে ভারত তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ হাসিনার পতনে খুব একটা নেগেটিভ কিছু বলে নি, যদিও তাদের মিডিয়াগুলোর ভাষা দেখলে মনে হয় ভারতের একটা বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে শেখ হাসিনার সরকারের পতনে ।
গত সময়ে ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকলেও এ যাত্রায় কার দাবার গুটি হয়ে চলবে খেলা, এটাও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলছেন । কিন্তু তবুও গত ১৫ বছরের শাষন-শোষনে অতীষ্ঠ মানুষগুলো তাকে-ই গ্রহণ করে নেবে । আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আসবে পুরো টিমের নাম, বলেছেন তেরাে সমন্বয়কের একজন নাহিদ ইসলাম । শিশুসহ শত শত ছাত্র-জনতার রক্তে পাওয়া এ অর্জন যেন আমাদের গণতন্ত্রের জন্য এক শুভ পদক্ষেপ হয়।ধ্বংসস্তূপ আর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠে একটা স্থিতিশীল বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে এ সরকারের প্রধান চ্যালেন্জ । সেজন্য হয়ত সময় নেবে অন্তর্বতীকালীন সরকার, তবুও স্থিতিশীলতায় নিয়ে এসে সকল দলের জন্য একটা নির্বাচনমূখী নিরাপদ পরিবেশ তৈরী করা হবে সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ । সুষ্ট নির্বাচনের মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব একটা গনতান্ত্রিক বাংলাদেশ যেন ফিরে আসে আগামীর দিনগুলোতে এটাই গোটা জাতির আকাংখা ।