যে দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, সেই দলই কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীন দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরেছে এমন ঘটনা বিশ্বে আর নেই। তবে তা ঘটেছিল বাংলাদেশে। সামরিক শাসকগোষ্ঠীর মদদ পেয়ে নিষিদ্ধ দল জামায়াতে ইসলামী শুধু যে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকারই পেয়েছিল তাই নয়, দলটির নেতারা, যারা পরে সরাসরি যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়েছেন, এমন বেশ কয়েকজন হয়েছিলেন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতায় নামে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (পরে ছাত্র শিবির)। আর জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামের বিভিন্ন হত্যাকারী বাহিনী। এসব বাহিনীর নেতৃত্বে থাকে জামায়াতের নেতারাই।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই জামায়াত নিষিদ্ধে উদ্যোগী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় জামায়াতে ইসলামী।
এছাড়া দালাল আইনে বিচার শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। হত্যা, খুন, গুম, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে প্রায় ৩৭ হাজার দণ্ডপ্রাপ্ত হন। এদের বড় অংশই ছিলো জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী।
রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে অস্তিত্বহারা হয়ে পড়ে জামায়াত নেতাকর্মীরা। আর দালাল আইনে দণ্ড হয় অসংখ্য নেতাকর্মীর। গ্রেপ্তার হয়ে জেলে ঢোকেন অনেকে। দণ্ড মাথায় পলাতক হয়ে যায় বহু। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের অস্তিত্ব কার্যত প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকে জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের ফিরতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পরই দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে।
যেভাবে আবার রাজনৈতিক অধিকার পেলো জামায়াত
১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। আর এর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তখন মি. সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে।’ আর এই সিদ্ধান্তের পরই বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রপট কয়েক দশকের জন্য অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের রাজনীতি যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ হবে না। এই কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার ১৯৭২ সালে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে, সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে দিলেন। সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চেতনা সব মুছে ফেললেন এবং জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনপ্রতিষ্ঠিত করলেন।
জিয়াউর রহমানের সময় অনুমতি পাওয়ার পরই আগ্রাসীভাবে রাজনীতির ময়দানে নামেনি জামায়াত। বরং তারা নেয় কৌশলী ভূমিকা। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ওপর ভর করে। ১৯৭৬ সালে ২৪শে আগস্ট কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জামায়াত মিশে গঠন করে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল)। কারাগার থেকে বেরিয়ে নিষিদ্ধ জামায়াত নেতারা জড়ো হতে থাকেন এই আইডিএলের ঢালে। আত্মগোপন থেকে জড়ো হতে থাকেন অনেকে।
আর এই অবস্থার মধ্যে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আইডিএলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয় বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতা। সেই নির্বাচনে ছয়জন জামায়াত নেতা ভোটে জিতে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে যান। এরপরই স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে শুরু করে জামায়াত। ওই বছরেই (১৯৭৯) ঢাকায় একটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কনভেনশনে গোলাম আযমের ভাষণ পড়ে শোনানো হয়। সেখানেই অনুমোদন দেয়া হয় নতুন গঠনতন্ত্র। এরপরই চার দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে পড়ে জামায়াতে ইসলামী।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘জামায়াতে ইসলাম এই অঞ্চলে ১৯৫৪ সালে রাজনীতি শুরু করে এবং জিয়াউর রহমান তাদেরকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
এই গবেষক মনে করেন, জিয়াউর রহমানের সময় আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলাম প্রথমে আইডিএলের ব্যানারে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এরপরই ১৯৭৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা জালালকে হত্যার মাধ্যমে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে তারা। সেই থেকে এখন পর্যন্ত জামায়াত হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। যখনই সুযোগ পেয়েছে- ছাত্র, নিরীহ নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে তারা।
শাহরিয়ার কবির বলেন, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযোদ্ধাদেরও হত্যা করেছে। যখনই সুযোগ পেয়েছে তারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত ঘনিষ্ঠতা শুরু থেকেই
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পর দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত জামায়াত নেতারা। তারা সংসদ সদস্য হয়েছে, হয়েছেন মন্ত্রী। বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াত নেতারা গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। সেখানে পুনর্বাসিত করা হয় ছাত্র শিবিরসহ সমমনোভাবাপন্ন রাজনৈতিক সহকর্মীদের। আর সঙ্গে চলে হত্যাকাণ্ডসহ সন্ত্রাসের রাজত্ব।
শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের রাজনীতিটাকে আবার পুনপ্রতিষ্ঠিত করেছে বিএনপি। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে মানুষের মধ্যে জামায়াতের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। মানুষ ভুলে যায়নি যে, ১৯৭১ সালে জামায়াত কী করেছিল।
তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বহুবার বলেছেন যে, জামায়াত-বিএনপি একই মায়ের সন্তান, ছাত্র শিবির-ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাওয়া জামায়াত আরেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদের সময়ও সংসদে আসন পায়। ১৯৮৬ সালে ১০টি আসন পায়। তবে জামায়াত ফুলে ফেঁপে ওঠে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে তারা ১৩ শতাংশ ভোট পায় এবং ১৮টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়। সে সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির সরকার গঠনে সমর্থন দেয় জামায়াতে ইসলামী।
আর এই সময়ই বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম কলঙ্কিত ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতারা পর পাকিস্তানে পলাতক থাকা জামায়াতের শীর্ষনেতা মানবতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযম ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর আমিরের দায়িত্ব নেন, যদিও তিনি দেশে ফেরেন তার আগেই, সামরিক শাসনের সময়।
পরের নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে তখন দাপট হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতা বিরোধী দলটি। মাত্র আট শতাংশ ভোট পেয়ে তিনটি সংসদীয় আসনে জয় পায়।
তবে পরিস্থিতি আবার ঘুরে যায় ২০০১ সালের নির্বাচনে। এবার বিএনপির সঙ্গে সরাসরি জোট বেঁধে ভোটে নামে দলটি। পুনরায় মোটাতাজা হয়ে ওঠে জামায়াত নেতারা। বিএনপির জোটসঙ্গী হয়ে সেবার ১৭টি আসন পায় জামায়াত।
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী বানানো হয়। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই দুই জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে তাদের ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। কিন্তু এই নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারে না। মাত্র দুইটি আসন পায়। এরপর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি জামায়াত।
জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের বিকল্প নেই
রাজনীতির শুরু থেকেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সন্ত্রাসের ইতিহাস। আইয়ুব খানের সময় পাকিস্তানেও নিষিদ্ধ করা হয় জামায়াতকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মো. মুজাহিদ, নায়েবে আমির আব্দুস সোবহান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, মো. কামরুজ্জামান, শুরা সদস্য মীর কাসেম আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের আমিরের দায়িত্বে থাকা গোলাম আযম এবং নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুজনেই কারাগারে মারা গেছেন।
শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াত যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সন্ত্রাস-নাশকতা করেছে। ২০১৩ সালে আমরা দেখলাম, হেফাজতে ইসলাম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এই জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা একইভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চক্রান্ত করেছিলো। তাই আমরা বলছি, এখন সময় এসেছে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসের জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী আইন আছে।