কথার পিঠে কথা উঠে আসে, যেমনি আসছে কোটা নিয়ে । কোটা আন্দোলনের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল আন্দোলন, শতস্ফুর্ত আন্দোলন । বিএনপি-জামাতের মত শক্তিশালি সংগঠনগুলো যখন একে একে রাজপথে পর্যদুস্ত হয়েছে, ঠিকে থাকতে পারে নি, শুধু সরকার পতনের তাদের আন্দোলনে দেশের মানুষ কোন ভরসা রাখতে পারে নি । কারন জনস্পৃক্ত ইস্যূ ছাড়া সরকার পতনে সাধারন জনতার কোন কিছুই যায় আসে না । জনগণ এটা ভাল করেই জানতো, তাই সরকার খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিএনপি কিংবা জামাত কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে কাবু করেছে । রাজপথ নিস্থব্দ হয়ে গিয়েছিলো, ব্যর্থতার ক্লান্তি নিয়ে দলগুলো বসে বসেই কাটাচ্ছিলো সময় । বিবৃতি দিয়ে আর দলকে কতটুকু চাঙ্গা রাখা যায় ?
রাজনীতির এক অদ্ভুদ স্থবিরতার মধ্যি দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো দেশের হাইলেভেলের দূর্ণীতিবাজদের খবর । ঘুষ, ডাকাতী, তথা দুর্বত্তায়নের মধ্যি দিয়ে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ কোটি টাকা কুক্ষিগত করা আর বিদেশে পাচারের নিউজগুলোও যেন আমাদের প্রতিদিনের গা সওয়া এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো । দেশের মানুষের লােখো কোটি টাকা কিংবা মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ডাকাতী কিংবা বিদেশে পাচার করে দেয়ার ঘঠনাগুলো কে ঢাকা দিতেই যেন দূর্ণীতিবাজদের জন্য সাপে বর হয়ে আসল ছাত্ররা । এখন আর দূর্ণীতির খবর নেই । তথা প্রশাসন নামক যন্ত্রের ছত্রছায়ায় ক্রমশ বেড়ে উঠা ১৫ লক্ষ টাকার খাসী ক্রয়কারী, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর পিয়নের ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ কিংবা প্রশ্ন পত্র ফাঁসের নতুন ক্যাডাররা এখন অন্তরালে চলে গেলো । হয়ত এখন লুকিয়ে লুকিয়ে তারা কোটা আন্দোলন টিকিয়ে রাখতে চাইবে কিছু দিন. ততদিনে কানাডা আমেরীকা কিংবা পশ্চিমের দেশগুলোর দোয়ারে তারা পা দিয়ে দিব্যি সময় কাটাবেন, করবেন সমুদ্র বিহার ।
কোটা আন্দেলনে জনস্পৃক্ততা আছে, এতে শিক্ষার্থীদের আছে ভবিষ্যতের এক স্বপ্নিল হাতছানি । স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরাও এই আন্দোলনকে ন্যায্য দাবী হিসেবেই ধরে নিয়ে তাদের সন্তানদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন । প্রত্যেকটা মানুষই তাঁর আগামী প্রজন্মের একটা উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য তাদের জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করে। আর তাই প্রত্যেকটা সন্তানের পেছনে তাদের অর্থ-শ্রম-মেধার নিশ্চিত ফল পেতে এই আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছেন দেবেনও । একটা কথা এখানে আমাদের মেনে নিতে হবে, নিছক সরকার পাল্টানোর জন্য এ আন্দোলনে যেমন ছাত্ররা সম্পৃক্ত হয় নি, ঠিক তেমনি এ আন্দোলনে যারা পুলিশের গুলিতে কিংবা ছাত্রলীগের নির্যাতনে মারা গেছেন, তাদের প্রায় সবাই-ই সাধারন ছাত্র । যুগে যুগে সাধারনরাই তাদের অধিকারের জন্য জন্য জেগে উঠে, করে কিছু অসাধারন কাজ । ৫২, ৬৯, ৭১ , সাধারনরাই লড়েছে, সৃষ্ঠি করেছে ইতিহাস এবং এরা ছাত্রই ছিলো, শিক্ষার্থীরাই জাগিয়ে তোলেছে জনতা ।
পাকি আমলেও এনএসএফ ছিলো , সব সরকারের আমলেই তাদের নিজস্ব বাহিনী ছিলো । এটা থাকবেই । কারন খুন-টেন্ডার-ধর্ষনে এরা সরকারের আসকারা পায়, সুতরাং তারা লটিয়াল নয়, বন্দুকধারী হয়েই তার উপরওয়ালাকে রক্ষা করতে চাইবে । এবারেও তা-ই হয়েছে, হচ্ছে । কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা গেছে, ক্যামনে জানি, সব পাল্টে গেলো, বহু পরাক্রমশালী কথিত ছাত্রনেতারা চোরের মত হল থেকে পালিয়ে গেলো, এদেরকে অবাঞ্চিত ঘোষনা করেছে সাধারন ছাত্রসমাজ ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের পাওয়া গেছে এই কোটা আন্দোলনে, বলা হচ্ছে জামাত-শিবিরের কর্মীরাও আছে এতে । তারা এ-ও বলছেন এরা এখানে থাকা মানেই অন্য কিছু । তাহলে আমরা যদি বলি , আন্দোলন থামাতে পুলিশ-র্যব বিজিবি আছে, ছাত্রলীগ কেন ? এর উত্তরটা কি হবে ? তাছাড়া ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠনের সাধারন সম্পাদক যখন ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ঠ’ বলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান, তখন কেন অন্যান্য সংগঠন এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অপরাধ করবে ? ছাত্র লীগ সরকারের হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে রাস্তায় নামতে পারে সেখানে সাধারন শিক্ষার্থীদের উত্তাল আন্দোলনে ছাত্রদলের থাকাটা অনুচিৎ হয় কিভাবে অর্থাৎ যে কোন ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা এখানে থাকবেই, আছেও । সর্বোপরী কোটা আন্দোলনকে যদি একটা সন্ত্রাস হিসেবে কালিমা দেয়ার চেষ্টা চলে, তবে সেই কালিমার সিংহভাগই পড়বে সরকারের উপর । যা সুপ্রিম কোর্টও প্রমান দিয়েছে, রায়ের মধ্যি দিয়ে । কারন শত শত শিক্ষার্থীর রক্তের দায়ভার আর কারো নয়, প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকার রাজাকার’ খেলার মধ্যি দিয়েই তিনি হয়ে উঠৈছিলেন আগ্রাসী নীতির একজন নেত্রী, যা দেশের মানুষ কোনভাবেই গ্রহণ করতে পারে নি । কারন কেউই তাদের সন্তানদের দেয়া সেই ৭১ এর গালিকে মেনে নিতে পারে নি । ২০-২২ বছরের তরুন-তরুনী কিংবা তারও কম বয়সীরা আর যাই হোক রাজাকার নামক বিশ্বাসঘাতকদের গালি নেবে কেন ? অভিভাবকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই তো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ । সুতরাং রাজাকার বলাটা বুমেরাং হয়েছে এবং এটা প্রমানীত হয়েছে রাজাকার একটা গালি এবং এই গালি আর যাই হোক নব্য রাজাকার (চেতনাবাজ হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী-পাচারকারী দেশদ্রোহী, চিহ্নিত রাজাকারদের বশংবদ) পরিবেষ্টিত সরকারের এই খেলাকে আর জনগণ পাত্তাই দেবে না । কারন ঠেকায় পড়লে বাংলাদেশের সব মানুষ রাজাকার, আর তাদের স্বজন-জেলা-উপজেলা কমিটিতে রাজাকার কিংবা রাজাকারদের পোলা-নাতীরা থাকবে বহাল তবিওতে । এ ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে কেউই এখন আর গুরুত্বের চোখে দেখবে না, অথচ এই রাজাকার শব্দটি থাকা উচিৎ, গালি হিসেবে মির্জাফরের মত ।
উচ্চ আদালতের রায়ে কোটা সংস্কারের ঘোষনা এসেছে । মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা ৫, নৃগোষ্টি ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ ১ শতাংশ । নিঃসন্দেহে এই-ই ছিল ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য । অথচ মাত্র একটা দৃঢ় আশার বাণীতে কিংবা সংলাপে তা-ই হয়ে যেতো রক্তের হুলি খেলার আগেই । তাহলে উচ্চ আদালতের রায়ের পর এখানেই হয়ত ছাত্র আন্দোলন থেমে যাবার কথা । কিন্তু তা কি থেমে যাবে এ প্রশ্নটা আসতে পারে । কারন শিক্ষাঙ্গনে কিংবা রাজপথে মুত্যু যে প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেছে । শিক্ষার্থীরা ফিরে যাচ্ছে না । এরা শাষকদের সাথে আলোচনায় যাচ্ছে কি-না, এ নিয়েও আছে ধুম্রজাল । দেশে যখন জনরোষ বন্ধ করা যায় না, তখন দেশকে অন্ধকারে ঢেকে দিতে হয় । অর্থাৎ ফোন-ইন্টারনেট বন্ধ । দেশ গত তিন-চারদিন থেকে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন । স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ।
আমরা পাকিস্থান আমলকে আমাদের দুঃসহ একটা কাল হিসেবেই মনে করি । ২৫শে মার্চের রাত বাঙ্গালি জাতির জন্য এক নিকষ কালো রাত্রি এবং এটা আমদের জাতির এক দুঃসহ রাত । একাত্তরের সেই রাত থেকেই রাষ্ট্রের যেন নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রক্ত-খুনে মেতে উঠেছিলো পাকিস্থানীরা । কিন্তু আমাদের এ সময়ের কালো অধ্যায়টা এমন যে, মাত্র একশ দেড়শ ঘন্টায় দিনে-দুপুর পাখির মত গুলি করা হয়েছে ছাত্র-জনতার উপর । একটা দেশে তখনই কারফিউ আসে, সেনাবাহিনী রাস্তায় নামে, যখন জাতিয় দুর্যোগ আসে । কিন্তু আজকের সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে এরশাদের মত ট্রাক মিছিলের উপর তোলে দিতে সাহস করে নি, একাজগুলো দেশের পুলিশই করতে পারে । গণমাধ্যমে কোনো আপডেট নেই । মাঝে মাঝে ঝলকে উঠে কিছু ছবি । বলতে হবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন এক রাষ্ট্র, সেখানে কি আছে আমরা জানি না । যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে তখনই, যখন জনগণ শাষকদের আর দেখতে চায় না, তখন শাষকরা শুধু নিজেদের চেহারাই বার বার দেখে ।
আমরা এরশাদ সরকারের স্বৈরাচার দখেছি । এক দশকের বেশী সময় ক্ষমতার দম্ভ নিয়ে থাকা এরশাদের কথা উঠলেই স্বৈারাচারী এক শাষকের মুখ আমাদের মানসপটে উঠে আসে । স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন মানেই সেলিম দেলোয়ার তাজুল ময়েজ মিলন বসুনিয়া সহ শত নাম । কিন্তু কোটা আন্দোলন মাত্র এক সপ্তাহের, সেখানে খুন হয়ে যাওয়া ছাত্র-শ্রমিক-সাংবাদিকদের শত শত নাম । এরশাদের সময়ের জনপ্রিয় শ্লোগান প্রতিবাদী নুর হোসেনের ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাকে’র মত কোটা আন্দোলনে বুক সটান করে দাঁড়িয়ে থেকে গুলি খেতে খেতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া আবু সাঈদসহ শত শত জনতার নামকে মাড়িয়ে কিভাবেই আবার স্বাভাবিক হবে ছাত্র সমাজ, আন্দোলন কি থামানো যাবে, না-কি ছাত্রদের দাবী এরশাদের শেষ সময়কালীন ‘এক দফা এক দাবী’ হয়ে যাবে ?
একটা নতুন শ্লোগান শোনা যাচ্ছে ‘কোটা তুলে নেয়, আমার ভাইদের ফিরিয়ে দেয় ‘—এটা ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করবে না, বরং প্রশ্নবিদ্ধ করবে । আর কোনো রক্ত নয় । এখন এমন যে কোন হঠকারীতা অতীতের অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে, বরং সুনির্দষ্ট দাবী সামনে আনা যেতে পারে ।
স্বৈরাচারকে এখন যে কেউ বিচার করতে পারবে । নব্য রাজাকারদের চিনতেও ভুল করছে না জাতি । কারন সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাজাকারও হয় না, স্বৈরাচারও হতে পারে না ।
রক্তের খেলা বন্ধ হোক, শত শত ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের বিচার নিশ্চিত হোক , যে ছাত্র-জনতা হারিয়ে গেছে তাদের পরিবারের অন্তত অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার একটা পথ আসুক, স্বস্থি নেমে আসুক, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকুক, শেষ কথা, জনতাই বলুক কে চালাবে দেশ ।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
faruk.joshi@googlemail.com